আমাদের বাংলাদেশ একটি বিস্ময়কর দেশ,আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অনন্য সব রত্ন যার মধ্যে বেশির ভাগই হয়তো আমি বা আপনি হয়তো চিনি না। সুন্দরবন কিংবা কক্সবাজারের মতো জনপ্রিয় স্থান ছাড়াও এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেগুলো এখনও পর্যটকের ভিড় থেকে দূরে, শান্ত ও নিসর্গময় যা আমাদের হ্রদয় কে নিমিষেয় শান্ত করে দিতে পারে । যারা আমার মত শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে প্রকৃতির মাঝে কিছুদিন নির্জনে কাটাতে চান, তাদের জন্য আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এই লেখাটি। এই ৭টি গন্তব্য শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয়, কম খরচে ভ্রমণের দিক থেকেও একেকটি দারুণ অপশন।
এই ব্লগে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রতিটি গন্তব্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য, যাতায়াত খরচ, থাকার ব্যবস্থা, ট্রাভেল গাইড ও ভ্রমণ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে আপনি সহজেই পরিকল্পনা করতে পারেন।
১. 🏞️ পাতাছড়া জলপ্রপাত, খাগড়াছড়ি
অবস্থান: পানছড়ি, খাগড়াছড়ি
প্রকৃতি: জলপ্রপাত | ট্রেকিং | বনজ প্রকৃতি
পাতিছড়া জলপ্রপাত খাগড়াছড়ির এক গোপন রত্ন যার সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানা নাই। চারপাশে সবুজে ঘেরা ৩০ ফুট উঁচু এই ঝরনা প্রাকৃতিক শান্তির অনন্য প্রতীক এবং যা দেখে আমার মত আপনিও অবাক হতে বাধ্য। জলপ্রপাতের নিচে তৈরি হওয়া পুকুরে গোসল করা যা আমার জন্য ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
ঢাকা → খাগড়াছড়ি (৮-১০ ঘণ্টা, নন-এসি ৬৫০৳, এসি ৯৫০৳)
খাগড়াছড়ি → পানছড়ি (সিএনজি বা লোকাল বাস, ৫০–১০০৳)
এরপর ট্রেকিং (স্থানীয় গাইডসহ ২–৩ ঘণ্টা)
{*সময় হিসেবে পরিবর্তন হতে পারে}
প্রায় খরচ:
যাতায়াত: ১৫০০–২০০০৳ (রিটার্ন)
গাইড ফি: ৫০০৳ (গ্রুপ হলে ভাগ করে নেওয়া যায়)
থাকার ব্যবস্থা: হোটেল ৬০০–১২০০৳/রাত
ভ্রমণ পরামর্শ:
ট্রেকিং জুতা ও পানির বোতল নিতে ভুলবেন না। কারন মূল স্পটের আশে পার্শ্বে তেমন খাওয়ার পানির কোন উৎস নেই।
মে–অক্টোবর সময়টা সবচেয়ে সেরা সময়।
স্থানীয় বা আগে থেকে ঐ জায়গা সম্পর্কে জানে তেমন কাউকে সাথে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ।
২. 🌊 চর কুকরি-মুকরি, ভোলা
অবস্থান: চরফ্যাশন, ভোলা
প্রকৃতি: দ্বীপ | হরিণ | ম্যানগ্রোভ বন | পাখি পর্যবেক্ষণ
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেঁগে উঠা এক শান্ত দ্বীপ, যেখানে প্রকৃতি আজও প্রাণবন্ত অতীত বাংলার এক প্রতিচ্ছবি। শীতকালে অতিথি পাখির আনাগোনা এই চরকে করে তোলে এক জীবন্ত অভয়ারণ্য যা নগরায়নের এইযুগে এক বিলুপ্ত প্রায় দৃশ্য।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
ঢাকা → বরিশাল (বাসে ৬৫০৳)
বরিশাল → ভোলা (ফেরি ও বাসে ২০০৳)
ভোলা → চরফ্যাশন (১০০৳)
চরফ্যাশন → চর কুকরি-মুকরি (ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ২০০–৫০০৳)
প্রায় খরচ:
যাতায়াত ও থাকা: ২০০০–৩০০০৳ (সাধারণত ২ দিনের জন্য)
গাইড (ঐচ্ছিক): ৫০০৳
থাকার ব্যবস্থা: গেস্ট হাউস/মোটেল ৩০০–৮০০৳/রাত
ভ্রমণ টিপস:
স্থানীদের মতে ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে পাখিরা ভিড় জমায়
কিছু সময় স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হতে পারে
খাবার ও পানির ব্যবস্থা আগেই করে রাখুন
৩. 💧 কমলদহ ঝরনা, সীতাকুণ্ড
অবস্থান: সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম
প্রকৃতি: জলপ্রপাত | হাইকিং | পাহাড়ি পথ
কমলছড়ি ঝরনা একটি নির্জন জলপ্রপাত, যেখানে পৌঁছাতে হলে আপনাকে ট্রেকিং করতে হবে পাহাড়ি পথে। কিন্তু কষ্টের পর পুরস্কার হিসেবে যা পাবেন তা অবিস্মরণীয়।সবচেয়ে মজার বিষয় হলো চট্টগ্রামের অনেকে এই ঝরনা সম্পর্কে জানেন না।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
ঢাকা → চট্টগ্রাম (বাস/ট্রেন ৫৫০–১২০০৳)
চট্টগ্রাম → সীতাকুণ্ড (বাসে ৫০৳)
হেঁটে/ট্রেক করে ঝরনায় পৌঁছাতে হয়
প্রায় খরচ:
আনুমানিক ১৫০০–২০০০৳ (একদিনে ঘুরে আসা সম্ভব)
গাইড (ঐচ্ছিক): ৩০০–৫০০৳
থাকার ব্যবস্থা: হোটেল ৫০০–১০০০৳/রাত
কম খরচে একদিনের অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপ, সীতাকুণ্ডের এই ঝরনা হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য।
৪. 🌳 রেমা-কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্ট, হবিগঞ্জ
অবস্থান: চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ
প্রকৃতি: জঙ্গল | বন্যপ্রাণী | ট্রেইল
রেমা-কালেঙ্গা একটি বিশাল জঙ্গল যেখানে আপনি পেয়ে যাবেন প্রকৃতির নির্মলতা, পাখির ডাক ও সবুজের স্নিগ্ধতা।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?:
ঢাকা → হবিগঞ্জ (বাসে ৫৫০৳)
হবিগঞ্জ → চুনারুঘাট → রেমা-কালেঙ্গা (সিএনজি বা লোকাল বাস)
প্রায় খরচ:
আনুমানিক ২০০০–২৫০০৳ (দিনভিত্তিক)
গাইড: ৫০০৳ (আবশ্যিক)
থাকার ব্যবস্থা: বন বিভাগের রেস্ট হাউস / স্থানীয় হোটেল (৬০০–১২০০৳)
পরামর্শ:
উক্ত স্থানে গাইড ছাড়া প্রবেশ নিষেধ
পূর্ব বুকিং করে আসা সবচেয়ে ভালো। অন্যতায় আপনার ও আমাদের মত খারাপ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
৫. 🌄 মদপানিয়া ঝরনা, আলীকদম
অবস্থান: আলীকদম, বান্দরবান।
প্রকৃতি: জলপ্রপাত | ট্রেকিং | দুর্গম পথ
একেবারে দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা এই ঝরনাটি এখনো খুব কম পরিচিত।আমার মতো রোমাঞ্চপ্রেমীদের জন্য এটি একটি স্বপ্নপুরী।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
- ঢাকা → চট্টগ্রাম (বাস/ট্রেনে ৫৫০–১২০০৳)
- চট্টগ্রাম → আলীকদম (লোহাগাড়া হয়ে লামা পর্যন্ত বাসে, প্রায় ৩০০৳
- লামা → আলীকদম (লোকাল বাস/চাঁদের গাড়ি/মোটরবাইক, ১০০–২০০৳)
- আলীকদম → মদপানিয়া ঝরনা (ট্রেকিং, প্রাথমিকভাবে ২–৩ ঘণ্টা)
প্রায় খরচ:
আনুমানিক ৩০০০–৩৫০০৳
গাইড ফি: ৫০০–৭০০৳
থাকার ব্যবস্থা: হোটেল ৬০০–১০০০৳/রাত
বিঃদ্রঃ:
বর্ষাকালে ঝরনার রাস্তাগুলো প্রচন্ড রকম বিপজ্জনক হয়। তাই এই সময় না যাওয়াটাই উত্তম।
মোবাইল নেটওয়ার্ক বেশিরভাগ জায়গায় থাকে না
৬. 🌀 মারায়ন তং , রাঙ্গামাটি
অবস্থান: বিলাইছড়ি, রাঙ্গামাটি
প্রকৃতি: পুকুর | ট্রেকিং | ধর্মীয় গুরুত্ব
এটি স্থানীয়দের কাছে ধর্মীয় ও প্রাকৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানকার নীল জল ও পাহাড়ি পরিবেশ দেখে আমি আপনি মুগ্ধ হতে এক প্রকার বাধ্য।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
ঢাকা → রাঙ্গামাটি (বাসে ৭০০৳)
রাঙ্গামাটি → বিলাইছড়ি (নৌপথে ৩০০৳)
বিলাইছড়ি → ট্রেকিং করে গন্তব্য
প্রায় খরচ:
আনুমানিক ৩০০০–৩৫০০৳
গাইড (আবশ্যিক): ৫০০৳
থাকার ব্যবস্থা: রেস্ট হাউস/মোটেল (৮০০–১২০০৳/রাত)
সতর্কতা:
কিছু কিছু সময় স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হতে পারে
এলাকাবাসীর সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখান এবং তাদের কিছু যদি আপনার পছন্দ না হয়ে থাকে তবে তা এড়িয় চলুন ।
৭. 🏛️ পাহাড়পুর গুহা-পথ, নওগাঁ
অবস্থান: বদলগাছী, নওগাঁ
প্রকৃতি ও ইতিহাস: গুহা | ধ্বংসাবশেষ | ইতিহাস
পাহাড়পুর বিহারের পাশে রয়েছে কিছু গোপন গুহা ও রহস্যময় পথ, যা অনেক আমাদের অনেকেরই অজানা। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি একটি গোপন ধনভাণ্ডারের চেয়ে কোন অংশে কম না।
কিভাবে যাবো এবং আমার কত টাকা খরচ হতে পারে?
ঢাকা → নওগাঁ (বাসে ৫৫০৳)
নওগাঁ → পাহাড়পুর (বাস/রিকশা)
প্রায় খরচ:
আনুমানিক ১৫০০–২০০০৳ (দিনভিত্তিক)
প্রবেশ ফি: ২০–৫০৳
থাকার ব্যবস্থা: হোটেল ৫০০–৮০০৳
বিশেষ টিপস:
স্থানীয় গাইড নিয়ে ভ্রমণ করলে প্রচুর পরিমাণ ইতিহাস জানা যাবে
শুক্রবার ও শনিবার পর্যটক বেশি হয় তাই এই দুই দিন বাদে অন্য দিন গুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
সর্বোপরি
বাংলাদেশের এই গোপন স্বর্গগুলো আমার মতো আপনার ভ্রমণের তালিকায়ও থাকা উচিত। এখানে আপনি পাবেন প্রকৃতির অমূল্য স্পর্শ, ভিড়মুক্ত পরিবেশ ও নতুন অভিজ্ঞতা। এই স্থানগুলোতে ভ্রমণ কেবল চোখের আরামই নয়, আত্মার পরিতৃপ্তি যা ইন্টারনেটের এই যুগে আমাদের শরীরও মনের জন্য অত্যান্ত জরুরী।
"Thank you for reading the full blog. Stay connected with InfoBEE.xyz for the latest updates and informative content."